- 25 August, 2024
- 0 Comment(s)
- 263 view(s)
- লিখেছেন : সরিতা আহমেদ
২০২৪ -এর অগাষ্ট একটি ঘটনাবহুল মাস। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর প্রয়াণ, পড়শি বাংলাদেশের গৃহযুদ্ধ- অশান্তি ও অরাজকতার খণ্ডচিত্রে আমরা যখন বিষণ্ণ, কূটনৈতিক অস্থিরতায় ক্রমাগত ইন্ধন জোগানো পড়শির ভারতবিদ্বেষী বার্তায় ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কে নয়া সংকট আসার দুর্ভাবনায় শঙ্কিত – ঠিক তখনই খাস কলকাতার বুকে ঘটে গেল আরেকটি নৃশংস ‘নির্ভয়া’ কাণ্ড।
৯ আগষ্ট মধ্যরাতে আর জি কর হাসপাতালের ট্রেনি মহিলা-ডাক্তারের নির্মম ধর্ষণ-খুন ঘটার পর থেকেই সারা রাজ্যে তথা দেশে একটি অস্থির ও আতঙ্কিত বাতাবরণ চলছে। ১০ আগষ্ট থেকেই ন্যায়বিচারের দাবিতে ছোট ছোট প্রতিবাদ সভা শুরু হয়েছিল শহরের বুকে। নানাশ্রেনীর, নানা বয়সের মেয়েরা ছোটছোট লেখায় ব্যক্ত করে তাদের শোক-শঙ্কা ও দ্রোহ। তেমনি একজন রিমঝিম সিনহা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা চালানো ছাত্রীটি নিজের সোশাল মিডিয়ার দেওয়ালে একটি অভিনব প্রতিবাদের বার্তা দেন –
“রাতকে দখল করো! আমি রিমঝিম সিনহা। শুনলাম আর জি কর-এর প্রিন্সিপাল বলেছে, রাতে মেয়েটির একা ওদিকে যাওয়া ঠিক হয়নি। রাতে একা থাকা ঠিক হয়নি। আমি রাতেই থাকবো। ১৪ অগাস্ট রাত ১১.৫৯ নাগাদ স্বাধীনতার, আমরা নারী স্বাধীনতার জন্য রাতে বাইরে থাকবো। গান গাইবো-গান শুনবো-আড্ডা দেবো। যা ইচ্ছে তাই করবো।
"রাত মেয়েদের জন্য সেফ নয়" / "পোষাক সেফ নয়" / "মেয়েটির চরিত্র ঠিক নয়"
এসব আর শুনতে বাধ্য নই । সারারাত বাইরে থাকবো। যারা থাকতে চান। কমেন্টে জানান।“
আন্তর্জালের অদৃশ্য তরঙ্গে ভেসে খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয় তাঁর সেই বার্তা। সুনামির মতো আছড়ে পড়ে মহানগর থেকে শহরতলি ছাপিয়ে মফস্বলে। দেড় দিনেরও কম সময়ে অজস্র পোষ্টার, প্ল্যাকার্ড, ব্যানারে সারা বাংলা জুড়ে প্রতিবাদ মিছিল ও জমায়েতের আর্জি রাখা হয়। নারীপুরুষ নির্বিশেষে সেসব দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে এবং প্রবাসীদের সৌজন্যে বিদেশেও।
তবে ‘নাইট রিক্লেইম’-এর সঙ্গে জুড়ে যায় কিছু সূক্ষ্ম রাজনীতিও। সঙ্ঘী ভাবাপন্নরা প্রতিবাদ-সভায় শঙ্খধ্বনির ডাক দেয়। বলাবাহুল্য, স্থান-কাল-পাত্র ভেদে পরিস্থিতি যাই হোক, মহিলা মানসে বিপ্লবের সঙ্গে এইসব ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট দ্রুত প্রভাব ফেলে। কারণ, ধর্ম যতই পুরুষের ধামাধরা হোক না কেন, ধর্মব্যবসার সবচেয়ে বড় মূলধন বাড়ির মেয়েদের মস্তিষ্কে গাঁথা মঙ্গল-অমঙ্গলের সুপ্রাচীন সংস্কার।
আর এই সংস্কারটির শেকড় যে কতদূর ছড়ানো তার আভাস মিলল ১৪ অগাষ্টের মধ্যরাতে। নিঃসন্দেহে সেই রাতটি ইতিহাসে তার নিজের একটা পাকাপোক্ত জায়গা করে নিয়েছে। ‘মেয়েদের রাত দখল’ ব্যাপারটি এদেশে অভিনব হলেও ইতিহাস বলছে ‘নাইট রিক্লেইম’ ব্যাপারটি আগেও বিদেশের মাটিতে ঘটেছে।
ইংল্যান্ডে ‘ইয়োর্কশায়ার রিপার্স মার্ডারস্’ নামে খ্যাত এক কেসে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে ও পুলিশি গাফিলতির প্রতিবাদে প্রথমবার রাতদখলের ইতিহাস রচিত হয় ১২ নভেম্বর ১৯৭৭ সালে। সেবার মহিলাদের মিছিলে স্তব্ধ হয়েছিল লীডস্ শহরের রাজপথ।
(১৯৭৭, প্রথম ‘নাইট রিক্লেইম’, লন্ডন)
রিমঝিম সিনহার পোস্ট সহ অন্যান্য লেখাপত্রেও মেয়েদেরকেই মূলত ডাক দেওয়া হয়েছিল রাতের দখল নিতে, কিন্তু কার্যত দেখা গেল প্রতিটি জমায়েতে পুরুষের প্রবল পেশীশক্তির উপস্থিতি।
‘নাইট ইজ আওয়ার্স’ মেয়েদের এই স্লোগানের অর্থ – লক্ষীমন্ত মেয়ের গুণ হিসেবে যেসব ট্যাবু সমাজে প্রচলিত সেগুলোকে চ্যালেঞ্জ করা। সমাজ ও পরিবারের মাতব্বরদের ‘গুড বুক’-এ থাকতে গেলে লক্ষী মেয়েদের বয়স অনুযায়ী পোষাক নির্বাচন করতে হয়, কম কথা, কম হাসি ও কম বন্ধুবান্ধব নিয়ে চলতে হয়, ‘সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফেরার কথা’ মাথায় রাখতে হয়, একা, ফাঁকা এবং অন্ধকার ইত্যাদি শব্দগুলোকে বাতিলের খাতায় ফেলতে হয়। এইসব ট্যাবুদের আঁকড়ে উপমহাদেশ জুড়ে গোটা দশেক প্রজন্ম চলছে – সেটা যে আদৌ কোনও নির্যাতন-নিরোধক ফিল্টার নয় তা বোঝানোই ছিল মূখ্য উদ্দেশ্য। দিন হোক বা রাত –একটি গণতান্ত্রিক স্বাধীন দেশে প্রতিটি নাগরিক সুরক্ষিতভাবে নিরাপদে কর্মক্ষেত্র থেকে বাড়ি ফিরতে পারবে –এটাই একটা সার্বভৌম প্রজাতন্ত্রের কাছে কাম্য। কিন্তু নাগরিকের লিঙ্গপরিচয় যদি মূখ্য বাধা হয়ে দাঁড়ায় তবে বুঝতে হবে সমাজ চালানোর সংবিধানে গোড়ায় গলদ রয়েছে। একজন প্রিন্সিপ্যাল যখন তাঁর ছাত্রীদের নিরাপত্তা প্রশ্নে তাঁকে ‘রাতে না বেরোনোর’র পরামর্শ দেয়, অথবা সরকারের মূখ্য উপদেষ্টা যখন বলেন “মেয়েদের নাইট ডিউটি দেওয়া যাবে না”- তখন সিস্টেমের অপদার্থতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
কিন্তু প্রশ্ন উঠল। ১৪ আগষ্ট রাত দখলের বিরাট কর্মযজ্ঞে, সব আশঙ্কা সত্যি করে বেশকিছু প্রশ্ন উঠল মেয়েদের নিরাপত্তা ঘিরেই। যদিও কলকাতা সহ ছোটবড় অনেক শহরেই কিছু ক্যাব সার্ভিস সেই রাতে খোলা ছিল, বাস ও অটোর ফ্রি-সার্ভিসের আহ্বানও ছিল, তবু প্রায় প্রতিটি শহর-মফস্বলের রাতের জমায়েতে অনেক মেয়েই এলেন পুরুষ সঙ্গীর হাত ধরে।
কারণ দেখালেন “অতদূরে যাব কী করে! তাই বর/দাদা/ভাই/বন্ধু/বাবা/কাকা/ছেলে বাইকে পৌঁছে দিল।” অথবা “আমার বাড়ির পুরুষেরা খুব লিবারাল। রাতে বেরোতে বাধা দেয় না। নিজে হাত ধরে পৌঁছে দিয়েছে।“
কিম্বা “বাবা হোক বা স্বামী আমাকে ওরা আগলে রাখে বাবা! তাই সঙ্গে এসেছে।“
কেউ কেউ যুক্তি দিলেন, “শোনো লড়াইটা তো মেয়ে বনাম ছেলেদের নয়। তাই শুধু মেয়েরা নয়, রাতের জমায়েতে ছেলেরাও আসবে।“
কেউ তর্ক করলেন, “বেশি নারীবাদ কপচাতে আসবেন না। আমার বাপ-ভাই-বয়ফ্রেণ্ডকে সমাবেশে যেতে বাধা দেওয়ার আমি/আপনি কে! তারা নিজেরা ঠিক করবেন কোথায় যাবেন।“
উপরোক্ত সবক’টি বক্তব্যই মেয়েদের। তাঁরা প্রমাণ করলেন আজও আধুনিক, কর্মঠ, স্মার্টফোনধারী মেয়েদের রাতে বাড়ির বাইরে যেকোনও কাজে একলা বেরোনোটা এখনও প্রায় প্রতিটা বাড়িতেই অনেকখানি কৈফিয়ত দাবি করে। দাবির মোড়কটি মেয়েদের নিরাপত্তা।
কিন্তু এত পুং-অভিভাবকের উপস্থিতি স্বত্ত্বেও সেই রাতে আবারও নারী নিরাপত্তাই প্রশ্নের মুখে পড়ল। হ্যাঁ, ঠিক যে বিষয় নিয়ে মেয়েদের প্রতিবাদ, এত স্লোগান, এত প্রচার, এত বৈপ্লবিক সভার মহাআয়োজন – সেই নিরাপত্তাটুকুরই অভাব টের পেয়েছে আমার মতো অনেকেই। আমার শহরে প্রায় লাখো মানুষের জমায়েতে পুরুষের সংখ্যা ছিল চোখে পড়ার মতো। রাতের দখল আর কেবলমাত্র 'মেয়েদের' হলো না। ছেলেদের ভিড় ঠেলে সামনে যেতে গিয়ে কনুই খেতে হল। ভিড়ের সুযোগ নিতে হাজির ছিল প্রচুর মলেস্টারও এবং তারা পুরুষই। ভগত সিং মূর্তির পাদদেশে কিছু মেয়ের পাশে দাঁড়ানো পুরুষেরাই দখল নিয়েছিল মাইকের। সমস্যা ওখানে ছিল না, ছিল জমায়েতের মধ্যিখানে ও রাস্তার ধারে। পুরুষদের ভিড়ে চোখে পড়েছিল দু’একটা রাজনৈতিক চিহ্নের টি-শার্টেরও, পুরুষালি পেশিসর্বস্ব ভিড়কে ঠেলে প্ল্যাকার্ড হাতে অনেক মেয়েই এগোতে পারছিল না। ধাক্কাধাক্কিতে মোলেস্টারের খপ্পরে পড়লেও আমি বেশ কিছু মেয়েকে টেনে সামনে এগিয়ে দিয়েছিলাম। একসময় মাইকে চিৎকার করে বলতেও হলো “মেয়েদের এগিয়ে আসতে দিন।“ দেখলাম ভিড়ের মেয়েরা মোমবাতি তুলে দিচ্ছে ভগত সিং মূর্তির 'দখল নেওয়া' ছেলেদের হাতে!! ছেলেদের সরে যেতে বললাম, “মেয়েদের নিজের মোমবাতি নিজেকে জ্বালাতে দিন” - বলতে একজন জানালো "আমরা তো হেল্প করছি। রেলিং টপকে এইভাবে মেয়েরা আসতে পারবে?"
- খুউব পারবে। সরে গিয়ে দেখুন।
ভেবেছিলাম জমায়েতে নিশ্চিন্তে নিরাপদে অনেকক্ষণ থাকব। একটা রাত আমাদের মেয়েদের দখলে থাকবে। সেই রাতে আমরা মেয়েরা গাইব, নাচব, যুক্তি তর্কে মাতব, প্রতিবাদে ফেটে পড়ব, কান্নায় ভিজব, হাসিতে গড়াগড়ি যাব, গদ্য-পদ্য বলব নিজের ভাষায়, নিজের স্টাইলে। কিন্তু পুরুষের ভিড়ে মিশে থাকা মদপ্যদের উগ্র দুর্গন্ধ আর ধাক্কাধাক্কি সহ্য হলো না। ৩০ মিনিটের বেশি দাঁড়াতে পারলাম না। পরদিন এক বান্ধবীর তিক্ত অভিজ্ঞতা শুনলাম - রাত ২টোয় বোনের সঙ্গে টোটোয় বাড়ি ফেরার পথে তাদের তাড়া করেছিল দুটি বাইক বাহিনী। অশ্লীল ইঙ্গিত ও চিৎকারে ভয়ে রীতিমত কাঁপতে কাঁপতে কোনওক্রমে তারা বাড়ি পৌঁছেছিল প্রাণ হাতে করে!
এক্টিভিস্ট নাসিমা ইসলাম তাঁর অভিজ্ঞতায় জানালেন - "Reclaim the Night" মুভমেন্ট সহ যেসব প্রতিবাদে মূলত নারী, queer, ট্রান্স মানুষদের পরিচালনা করার কথা, সেগুলো কিরকম একে একে পুরুষদের অংশগ্রহণে তাদের কুক্ষিগত হতে বসছে বলে মনে হচ্ছে না? সেদিন ১৪ আগস্ট রাতেও দেখেছি পুরুষরা কিভাবে পাশে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি। মদ খেয়ে, মাতাল হয়ে পাশে ঘেঁষে,শরীরে গুঁতো মেরে, টিজ্ করে, বাজে স্পর্শ করে যারপরনাই নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা বুঝিয়ে দিয়েছেন। আসলে, ব্যাকসিটে বসার অভিজ্ঞতা তাদের একেবারেই কম জীবনে, তাই স্লোগান বলুন, মিছিল বলুন, মিটিং বলুন - এসব কিভাবে মেয়েরা, রূপান্তরকামীরা, ক্যুয়ার'রা তাদেরকে বাদ দিয়ে করে ফেলছে এটা তাদের মাথায় ঢুকছে না, আর মাথায় ঢুকলেও তারা চরম ডিনায়ালে আছে! এখানে তাদের "বাদ" দিতে আমরা কেউ চাইনা, তারা অবশ্যই থাকুক। কিন্তু solidarity তে, ally হিসেবে, সাথী হিসেবে, সাহায্যকারী হিসেবে। তারাই যদি নারীদের থেকেও চার ডেসিবেল ওপরে আওয়াজ তুলে পুরুষতন্ত্র থেকে "আজাদী" চেয়ে বসে, তখন আমাদের অনেকের হাসি পায় বৈকি! কারণ বছরের বাকি ৩৬৪ দিন তারাই এই তন্ত্রটার শ্রেষ্ঠ beneficiary. তাই এই মুভমেন্টের প্রকৃত দাবি ও প্রসঙ্গ বুঝে পুরুষদের অবশ্যই নারী, trans, queer মানুষদের জায়গা দখল করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কাজটি কঠিন লাগলেও, এই অভ্যেস তাদের শিখতে হবে - সেটাও আমাদের এই বৈপ্লবিক আন্দোলনের একটা দাবি হওয়া উচিত। মেয়েদের বলছি, প্লিজ "মোহনবাগান, ইস্ট বেঙ্গল", "ঘটি বাঙ্গাল" ইত্যাদির সেন্টিমেন্ট দিয়ে অন্তত এই আন্দোলনকে পুরুষদের হাতে তুলে দেবেন না। এইরকম পেশীবহুল, চিতকৃত পৌরুষ্যের বন্দনা করা রোমান্টিকতার থেকে বেরিয়ে আসুন।
এই নারীবাদী resistance এর ব্যাকরণ প্লিজ অন্যরকম হোক, আর সেটা নির্ধারণ করুক শুধুমাত্র এই আপামর নারী, queer ও trans মানুষদের ঢল। কোনো সিস্-জেন্ডার পুরুষের মত্ত দল নয়!”
এক্টীভিস্ট শতাব্দী দাস লিখলেন – “বলা হয়েছিল 'মেয়েরা রাত দখল করো' কারণ কর্তৃপক্ষ বলেছিল, 'রাতে নির্যাতিতার বেরোনো দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ছিল।' অথচ আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রেস মিটিং-এ বলে দিলেন, 'রাতে মেয়েদের ডিউটি দেওয়া যাবে না' এমন অনুরোধ করা হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে। বিনীত ভাবে বলতে চাই, আমরা যা বলেছি, আর আপনারা যা দিচ্ছেন, দুটো পুরোপুরি আলাদা। আমরা রাতে যেখানেই থাকি, সেখানেই সুরক্ষিত রাত চাই। রাতে ডিউটি করতে না দিলে মেয়েদেরই কর্মসংকোচন হবে৷ আমাদের দাবি কিন্তু মানা হয়নি। ২৪ ঘণ্টা সরকারি গণপরিবহণ দিন, টয়লেট দিন ১কিমি অন্তর এবং ২৪ঘণ্টার জন্য গণপরিবহণ, পথঘাট ও কর্মস্থলকে সুরক্ষিত করুন। এসব করুন প্লিজ মেয়েদের রাতডিউটি বাতিল করার বদলে৷”
শিল্পী তন্ময় বিশ্বাস বললেন- "জানি আমাদের আশেপাশে যারা হাঁটছেন, অনেকেরই থাবার নীচে নখ লুকনো আছে। রাতদখলের রাতেই কত অঘটন ঘটেছে, এবং সেগুলো কোন ভাবেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সেগুলোর বিপক্ষেই এই বৃষ্টির রাতে রাস্তায় নামা। এর কোনটার জন্যই আন্দোলন বিন্দুমাত্র ছোট বা ব্যর্থ হয়ে যাবে না। এতটুকুও অসংগতি কিছু দেখে থাকলে আওয়াজ তুলুন। মনে রাখবেন, ইয়ার্কির ছলে বলা কথা "মেয়েদের মত চুড়ি পরে বসে থাক",অথবা " লেডিসদের মত হাঁটিস না।" থেকেই ধর্ষক মানসিকতা উঠে আসে। সেটা পুরুষ-নারী নির্বিশেষে সবার। তাই অল্প, খুব ছোট্ট কালো দাগ দেখলেও আওয়াজ তুলুন। নইলে হয়তো দেরি হয়ে যাবে।“
আন্দোলনে সামিল হওয়া কলেজ ছাত্রী দেবশ্রী জানালো ‘‘I want Justice’-স্লোগানটি মিছিলের অনেক পুরুষের মুখে হয়ে দাঁড়িয়েছিল ‘I want Just You’ স্লোগানে! তারাই বাড়ি ফেরার পথে জোরে গাড়ি চালিয়ে আমাদের দিকে কটূক্তি করতে করতে চলে গেল।“
বহু পুরুষের সলিডারিটির এই চেহারা, ভাবা যায়!
হোক প্রতীকি ,তবু একটি মাত্র রাত চেয়েছিলাম। স্বাধীনতা দিবসের একটি মধ্যরাত চেয়েছিলাম একান্ত নিজেদের হোক। হলো না। স্লোগানের চিৎকার সব্বার কানে বেজেছিল ঠিকই, কিন্তু আমাদের সুপ্রাচীন মজ্জাগত সংস্কারের শেকল বেজেছিল সপ্তমসুরে। সেই পুরুষের শেখানো সংস্কার - যা রাত দুটোয় বাড়ি ফেরা দুই বোনকে আতঙ্কিত করেছিল সেই রাতে। ওদের টোটোকে তাড়া করেছিল দুই মদ্যপ বাইক বাহিনী। ছিল কদর্য ইঙ্গিত ‘ রাতের মেয়েছেলেদের কাছে যা খুবই ন্যায্য!’
সেই রাতে আমার শহর বুঝিয়েছিল, মেয়েদের অনেককিছু শেখা বাকি আছে। পারমিশন নিয়ে বিপ্লব করা যায় না। চেনামুখের সঙ্গ নিয়ে প্রতিবাদ মিছিল করা যায় না। রাত সফর, বাবা-কাকা-দাদা-ভাই-বর বা প্রেমিকের হাত ধরে নয়, তাদের থেকে এক রাতের ‘বৈপ্লবিক পারমিশন’ নিয়ে নয় - নিজের স্ট্যান্ড নিজে একলা তৈরি করার সাহসটার নাম ‘স্বাধীনতা’। যে মেয়েটি একলা বেরোতে চেয়েছিল, রাতের আকাশকে সাক্ষী রেখে একলা দাঁড়াতে চেয়েছিল নিজের বাড়ির গলিমুখে – সেই মেয়ের পাশে দাঁড়াতে গেলে ‘একলা চলো’ নীতিকেই বেদবাক্য বলে মানতে হবে। “কে পৌঁছে দেবে?”- না ভেবে নিজের সাইকেল, স্কুটি নিয়ে বেরোতে হবে। ‘চালাতে জানি না’ বলা চলবে না, শিখতে হবে। নিজেদের জোটবদ্ধ হতে হবে একলা হাঁটার শর্ত মনে রেখেই। স্লোগান শুধু ছাপার অক্ষর কিম্বা গলার শিরা ফুলাবার জন্য নয়। মস্তিষ্কের কোষে গেঁথে নিতে হবে ‘আমার শরীর, আমার পছন্দ, আমার দেশ, আমার শহর, আমার স্বাধীনতা, আমার জন্মগত অধিকার।“ ব্যানারে লেখাগুলোর সঙ্গে একমত হলে তবেই মিছিলে নামতে হয়।
সামগ্রিক ভাবে ধর্ষণ/ শ্লীলতাহানীকে যদি পুরুষতান্ত্রিক বর্বরতা বলে সত্যিই মনে করেন, তবে ঠিক করে নিতে হবে লড়াইটা সামগ্রিক পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে, নাকি স্রেফ এই একটি ধর্ষণকাণ্ডের বিরুদ্ধে।
একরাতের উৎসব মুখরিত সেলফি জোন বা রীলের জন্য ‘নাইট রিক্লেইম’এর ডাক ছিল না। আপনার দিন, আপনার রাত একান্ত আপনার নাগরিক অধিকার। আপনার বাড়ি-ঘরের কোণ-দরজা-রাস্তা-পাড়ার মোড়-চায়ের দোকান-বিকেলের ঠেক-ক্লাব-পার্ক সবই আপনার স্বাধীন বিচরণের জায়গা। সেখানে যেতে হলে একজন প্রাপ্তবয়স্কের পারমিশান লাগে না। কাউকে কৈফিয়ত দিতে আপনি বাধ্য নন। আর যদি প্রতিনিয়ত লক্ষী মেয়ে হওয়ার টার্গেটে নিজেকে বন্দী করেন, তবে প্লিজ এসব জমায়েত আপনার নয়, ভাই। ঘরে থাকুন। অথবা সরকারের ফতোয়া মেনে নিন “মেয়েরা নাইট ডিউটি করবেন না।“
কবি হেলাল হাফিজের কথাটি প্রতিটি লড়াইয়ে প্রাসঙ্গিক- “এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’
তবে মিছিলে পা বাড়ানোর আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন সমাজের অদৃশ্য ‘গুড বুক’ নাকি নিজের ঘরের আয়না – কোণটায় স্পষ্টভাবে নিজের আত্মবিশ্বাসী চেহারাটা দেখতে পাচ্ছেন, মেয়েরা ?
0 Comments
Post Comment